আদি মধ্যযুগে ভারতবর্ষে কি সামন্ততন্ত্র গড়ে উঠেছিল? পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটতে শুরু করে। ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত শাসকগণ পূর্বেকার পরাক্রম হারাতে শুরু করে। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। বুধগুপ্ত (৪৭৬-৪৯৫) ছিলেন শেষ শক্তিশালী গুপ্ত রাজা। মৌখরীদের আক্রমণে অষ্টম শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভাঙনের যুগে ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখা যায়।

‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি বর্তমানে একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। ভারতবর্ষে গুপ্ত যুগে এর উদ্ভবের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে। কার্ল মার্কস তথা মার্কসীয় দর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়ে এক শ্রেণীর পন্ডিত গুপ্ত যুগে তথা প্রাচীন ও আদি-মধ্য ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

বিভিন্ন কারণে গুপ্ত যুগে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। 

প্রথমত, গুপ্তযুগের শেষ দিকে সমাজে ভূস্বামী শ্রেণি বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা এক একজন ‘স্বাধীন সামন্ত রাজায়’ পরিণত হন। 

দ্বিতীয়ত, সামন্ত প্রভুদের অধীনে কৃষক পরিবারগুলি স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার লাভ করে এবং তারা উৎপাদিত শস্যের নির্দিষ্ট অংশ ভোগ করার অধিকার পায়।

তৃতীয়ত, সামন্ত প্রভুগন কৃষক পরিবারগুলির সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক নতুন আর্থিক ব্যবস্থা, একেই বলা হয় ‘সামন্ততন্ত্র’। 

চতুর্থত, গুপ্তরাজগন উপজাতির নেতাদের পরাজিত করে তাদের কাছ থেকে আনুগত্য ও কর দানের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। গুপ্তরাজগন এই নেতাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিলে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ঘটে।

পক্ষে যুক্তি -

মধ্যযুগের ইউরোপ আর আদি-মধ্যযুগের ভারত এই দুই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ছিল বহু দিক থেকেই স্বতন্ত্র।

প্রথমত, জমির মালিকানাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপের রাজা ছিলেন তত্ত্বগত দিক থেকে একটি রাজ্যের সমস্ত জমির মালিক। কিন্তু বাস্তবে জমির মালিকানা বন্টিত ছিল বড় ভূস্বামীদের মধ্যে। বড় ভূস্বামী আবার জমি বন্টন করতেন ছোট ভূস্বামীদের মধ্যে। যারা জমি চাষ করত তাদের ভূমি-দাসগন বলা হত। ভূমিদাসদের খুবই স্বল্প জমি থাকত। অন্যদিকে, আদি মধ্যযুগের ভারতে জমির মালিক ছিলেন সামন্তরাজগন। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মযুদ্ধের (১০৯৬-১২৯১ খ্রিস্টাব্দ) পর বেশ কিছু সংখ্যক নগর গড়ে ওঠে। আদি-মধ্যযুগের ভারতে নগরের পরিবর্তে গড়ে ওঠে বেশ কিছু সংখ্যক নদী ও সমুদ্রবন্দর।

দ্বিতীয়ত, মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজ ছিল রাজা, সামন্ত, উপসামন্ত ও ভূমিদাস শ্রেণিতে বিভক্ত। অপরদিকে ভারতীয় সমাজ ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি বর্ণে বিভক্ত। ‘ভারতের সামন্ততন্ত্র’ সম্পর্কে আলোচনায় কোসাম্বি নিজস্ব ধারণা উপস্থিত করেছেন। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বিভিন্ন ধারণাকে তিনি ভারতের পটভূমিতে নতুনভাবে প্রয়োগ করেন। তিনি দেখিয়েছেন ‘ভারতের সামন্ততন্ত্র’ অভিধাটির অর্থ ও তাৎপর্য ভিন্ন। তিনি দেখিয়েছেন ভারতে ‘হেলট ছিল, স্লেভারি নয়’ একথা মেনে নিলে সমাজ বিবর্তনের মার্কসীয় পর্যায়ক্রমের একটি ধাপ পেরিয়ে যাওয়া হয়।

তৃতীয়ত, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফসল বলে মনে না করে একে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় আর একশ্রেণীর ঐতিহাসিকদের মধ্যে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - এফ. ডব্লু. মেইটল্যান্ড, টমাস ক্রেগ, অ্যাডাম স্মিথ এই শ্রেণির ঐতিহাসিকরা সামন্ততন্ত্রকে পিরামিডের আকারে দেখতে চেয়েছেন, যার সর্বোচ্চে অবস্থিত ছিলেন রাজা, অথচ তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বন্টিত হয়ে যেত একাধিক সামন্তদের মধ্যে। এই ব্যবস্থায় যেহেতু বহু সামন্ত ও উপসামন্তের আবির্ভাব ঘটত সেহেতু রাজকীয় সার্বভৌমত্ব যথেষ্ট বিঘ্নিত হত। ফলে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা যেমন প্রকট হয়ে ওঠে তেমনই আঞ্চলিক শক্তিগুলির অনিবার্যতা পরিলক্ষিত হয়।

চতুর্থত, গুপ্ত যুগের ভূমিদান প্রথাকে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে বলে রামশরণ শর্মা মনে করেন। নতুন জনপদ স্থাপনের জন্য ভূমিদানের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। এছাড়া পতিত জমিকে কর্ষণযোগ্য করে তোলার উপায় হিসেবে এই ধরনের জমি দানের আশ্রয় নেওয়া হয়। কেননা জমির মালিকের কাছে অনুর্বর জমি কোনও কাজে আসত না, যতক্ষণ না সেই জমিকে কর্ষণযোগ্য করে তোলা হত। তাই এই উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণকে আবার কখনও মন্দিরকে জমি দান করা হত।

বিপক্ষে যুক্তি -

ভূমিদানের ওপর নির্ভর করে কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে এসেছেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে ভারতে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ও বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু কোসাম্বি তা স্বীকার করেন না। তাঁর মনে ভারতের সামন্ততন্ত্রের প্রথম দিকে খ্রিস্টীয় সময় থেকে অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত।

প্রথমত, সামন্ততন্ত্রের বিবর্তনে কোসাম্বি দুটি পর্যায় লক্ষ্য করেছেন। যথা- ‘ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র ও নীচ থেকে সামন্ততন্ত্র’। ‘আদি সামন্ততন্ত্র’, ‘শুদ্ধ সামন্ততন্ত্র’ - এইসব ধারণাও তার বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। ওপর থেকে সামন্ততন্ত্রে সম্রাট কিংবা শক্তিশালী রাজা অধীনস্থদের কাছ থেকে নানারূপে বশ্যতা আর কর আদায় করেন। অধীনস্থগণ নিজের অধিকারে শাসন করেন, নিজ অঞ্চল নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী চলে। সম্রাট বা রাজাকে কর দিতে হত। কোনও মধ্যস্থ ছাড়াই অধীনস্থগণ শাসন চালায়। ওপর থেকে সামন্ততন্ত্রের সরকারি কর্মচারীরাই প্রত্যক্ষভাবে কর আদায় করত।

‘নীচ থেকে সামন্ততন্ত্র’ এর পরবর্তী পর্যায়ের। এই পর্যায়ে গ্রামে একশ্রেণির ভূস্বামীর উদ্ভব ঘটে। রাজা ও কৃষকের মধ্যবর্তী এরা ক্রমে স্থানীয় জনগণের ওপর সশস্ত্র আধিপত্য স্থাপন করেন। সামরিক পরিষেবার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ স্থাপিত হয় অন্য কোনও স্তরের হস্তক্ষেপ ব্যতীত। সুতরাং ‘ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ আর ‘নীচ থেকে সামন্ততন্ত্র’ এই দুইয়ের মূল পার্থক্য দেখা যায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য উৎপাদনের হ্রাসবৃদ্ধির দ্বারা।

দ্বিতীয়ত, সামন্ততন্ত্র কেন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল সে বিষয়ে কোসাম্বি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, পণ্য উৎপাদন। সেই সময়ে সমগ্র দেশজুড়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়। পণ্য উৎপাদন মাথাপিছু কমে যাওয়াতে একটি অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য গ্রামে তৈরি করা হত যথা- ধাতু ও লবণ। এগুলি বিনিময় মাধ্যমেই কেবল পাওয়া সম্ভব ছিল। তার জন্যেই কোনও না কোনও পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ আঞ্চলিক শস্যের ক্ষেত্রেও (যথা- তুলা) এই একই ব্যাপার দেখা যায়।

তৃতীয়ত, বাণিজ্য পণ্য রূপে ব্যবহার করলেও বণিকেরা নিজেদের উল্লিখিত প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি তৈরি করত না। আবার ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবার জন্য রাস্তা নিরাপদ রাখা প্রয়োজন ছিল। সুতরাং বাণিজ্যের জন্য উদ্ধৃত্তেরও প্রয়োজন ছিল। মূল খাদ্য উৎপাদক গ্রামের জমি ছিল সাধারণের হাতে, বাকি প্রান্তিক জমি ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগের জন্য উন্মুক্ত। এই জমিতে বসতকারী ব্রাহ্মণগণ ছিলেন নতুন শস্যের ‘মডেল’ উৎপাদক। তাম্রশাসনে লিখিত থাকত ব্রাহ্মণদের জমি প্রাপ্তির কথা। সাধারণত বিনিময়ের উদ্দেশ্যেই নতুন শস্য উৎপাদিত হত।

চতুর্থত, অগ্রাহার ব্যবস্থা তথা ব্রাহ্মণদের গ্রাম ও ভূমিদান প্রথার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের বীজ খোঁজার যে প্রচেষ্টা রামশরণ শর্মা নিয়েছেন তা ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মেনে নিতে রাজি নন। এমনকি শর্মা যে বলেছেন, ব্রাহ্মণদের প্রবর্ত অগ্রাহার ইউরোপীয় ম্যানর ব্যবস্থার সঙ্গে কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তাও যুক্তির আলোকে অগ্রাহ্য করেছেন এই শ্রেণির পন্ডিতেরা। এই প্রসঙ্গের প্রথমে দীনেশচন্দ্র সরকার বলেছেন, 'Landlordism and Tenancy in ancient and medieval India as revealed by epigraphical records' নামক গ্রন্থে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আলোচ্য সময় তাম্রশাসনগুলিতে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশিত হয়নি যার ভিত্তিতে বলা চলে যে, অগ্রাহার ব্যবস্থার সূত্র ধরে রাজশক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেয়েছিল। ড. সরকার আরও অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, দানগ্রহীতার কর ভোগ করার অধিকার থাকলেও কর সংগ্রহের প্রশাসনিক অধিকার তাঁর হাতে ছিল না। অন্তত এ যুগে লেখমালায় ওই ধরনের কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।


নবীনতর পূর্বতন