বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় শাখা হলো মনসামঙ্গল কাব্য, পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মঙ্গলকাব্যের বিস্তার। এই মঙ্গলকাব্য প্রধান ও অপ্রধান এই দুই ধারায় বিন্যস্ত। প্রধান ধারার তিনটি বিভাগ। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল তাদের নাম। মনসা দেবীকে অবলম্বন করে যে মনসামঙ্গল কাব্যধারা সূচিত, সেই মঙ্গলকাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে তুলে ধরব।
মঙ্গলকাব্যের আদি ধারা মনসামঙ্গল কাব্য। তোর কি আক্রমণের ফলে পৌরাণিক ও লৌকিক সংস্কৃতির সমন্বয়ে হিন্দু ধর্মের অবক্ষয় রোধে এবং বাংলার আদি ভৌতিক ও আদি দৈবিক চর্চার ফলে যে মঙ্গলকাব্য ধারা সূচনা সেই মনসামঙ্গল কাব্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনী হল-
মনসামঙ্গল কাব্যের নায়ক চাঁদ সদাগর, চম্পক নগরের বাকশালী বণিক। মনসা চাঁদ সদাগরের মাধ্যমে পূজা প্রচার করতে চান। চাঁদ সইবো, তাই তিনি মনসা পূজা করবেন না। মনসা ও নাছোড়বান্দা। তাই চাঁদ মনসার দ্বন্দ্ব এবং পরি নামে মনসার জয়। বনের চামশোদা করে ছয় পুত্র ও পুত্রবধূর সহ সুখের সংসার। শিব ভক্ত চন্দ্র ধর শিবের আশিশে মহা জ্ঞান কবজ লাভ করে ।অন্যদিকে দেবকন্যা মনষার দেব সমাজে প্রতিষ্ঠা নেই। শৈশবে বিমাতা চন্ডীর খোঁচায় তার চোখ কানা হয়। স্বামী জরৎকারু ও তাকে ত্যাগ করে। তাই শিব সিজুয়া পর্বতে মণমার থাকার ব্যবস্থা করেন। সিজুয়া পর্বতে থাকার মনমার সহচরী নেতা- তার সেবিকা ও সখী। একদিন মনসা স্বর্গের উদ্যানে শয্যায় সজ্জিত ছিলেন। এমন সময় চান্সই পুজার জন্য সেখানে ফুল তুলতে আসেন চাঁদের ভয়ে সাপেরা পালিয়ে যায় ।ফলে মনসা আবন্নহিনা হয়ে পড়েন ।চন্দ্রধরকে মর্তে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দেয়। অভিশপ্ত চন্দ্রধর মর্ত লোকে চম্পক নগর এ বিজয় মাথুর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর এক উদ্দেশ্যে স্বর্গের নর্তকী ঊষা ও তার স্বামী অনিরুদ্ধ শাপগ্রস্ত হয়ে মর্তলোকে জন্মগ্রহণ করেন। অনিরুদ্ধ হলো লক্ষিন্দর আর ঊষা উজানীনগরে সাইবেনের ঘরে বেহুলা নামে জন্ম নেয়।
আরো পড়ুন: মনসামঙ্গল কাব্যধারায় নারায়ণ দেবের কৃতিত্ব
মনসা চাঁদ সওদাগরকে দিয়ে পূজা করানোর সিদ্ধান্ত অটল। অন্যদিকে চাঁদ সওদাগর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কোনভাবে মনসা পূজা করবেন না। তাঁর স্ত্রী সোনোকা লুকিয়ে মনসা পূজো করলে রুষ্টান সদাগর পূজার ঘট লাথি মেরে ভেঙ্গে দেয়। চাঁদের সঙ্গে মনসা দেবী প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়।মনসার কোপে চাঁদ বুয়া বাড়ি নষ্ট হয়। চাঁদের ছয়পুত্র সর্পদংশনে প্রাণ হারায়। ব্যবসা-বাণিজ্য নৌকা গুলি ডুবে যাওয়ায় সে সর্বস্রান্ত হয়। পুত্রদের হারিয়ে তিনি যখন বাণিজ্য যাত্রা করে তখন ঝটিকা সংকুল সমুদ্রে মনসা চাঁদ সওদাগরকে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। বাণিজ্য তরী সদাগরকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। চাঁদের সম্মুখে মনসা একটি পদ্মফুল নিক্ষেপ করলে মনসার অপর নাম পদ্মা বোলে চান যে পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। সমুদ্রে ভাসাতে ভাসাদের যখন চাঁদ খুলে উপস্থিত হয় ,তখনও মনসা তাকে নানা পরীক্ষা করে।
আরো পড়ুন: মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য
সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন চাঁদ ঘরে ফিরে আসে তখন স্বামীর অবস্থা দেখে সনকা কেঁদে ওঠে। দুঃখ ,কষ্ট ,বিষন্নতার মধ্যে তাদের সপ্তম পুত্র লক্ষিন্দরের জন্ম হয়। পুত্রের সুখ দেখে চাঁদ সমস্ত দুঃখ ভুলে যায়। পুত্রবয়েস প্রাপ্ত হলে বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। মনসার কোপ থেকে তাদের রক্ষার জন্য সাঁতালি পর্বতে লোহার বাসর ঘর নির্মিত হয়। বিশ্বকর্মা কে দিয়ে মনসার বাসরঘরে একটি ছোট্ট ছিদ্র রেখে দেন। সেই ছিদ্র দিয়ে কালীয় পাশ প্রবেশ করে লখিন্দর কে দংশন করায় বেহুলার সিঁদুর মুছে যায়। লক্ষিন্দরের মৃত্যুতে চম্পক নগরে বেহুলার আর্তক্রন্দনে চমকে ওঠে।
সতী বেহুলা সাঙ্গুরের জলে কলার মাদ্রাসে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। নদীতে অনেক প্রলোভন, লালসা, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বেহুলা ভেসে যায়। মনসা সহছ প্রাণী নেতা ছদ্মবেশে ধোপানির কাজ করে। দুষ্ট পুত্রকে মেরে দোকানে কাজ সেরে তাকে আবার বাঁচিয়ে দেয়। এই অদ্ভুত দেশে নেতা পরামর্শে বেহুলা স্বর্গে পৌঁছে নৃত্য গীতে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে। দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে মনসা কে ডেকে তার স্বামীও ভাসুর দিয়ে বাঁচিয়ে দিতে বলে। চাঁদ কে দিয়ে মনসার পূজো করানোর প্রতিশ্রুতি পেলে মনসা রাজি হয়। শর্ত মেনে বেহুলা মৃত স্বামী ,ছয় ভাসুর , সপ্তডিঙ্গা মধুকর ও সমস্ত হারানো সম্পদ ফিরে পেল। বেহুলার অনুরোধে চান্স শেষ পর্যন্ত বাঁ হাতে কিছু ফিরে মনসার পূজো করে। চাঁদের পূজার পর মনসার পূজা মর্তে প্রচারিত হয়।
এরকম আরো বিষয় জানতে যুক্ত হন আমাদের WhatsApp কমিউনিটিতে (এখানে ক্লিক করুন)