মধ্যযুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অধিক রচিত বাংলা সাহিত্যের ধারা। দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার এইসব কাব্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলেও কাব্যের দিক থেকে বিশেষ করে মধ্যযুগের বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এর সজীব লেখচিত্র হলো এই মঙ্গলকাব্য গুলি।সমালোচক আসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন: "যথার্থ মঙ্গলকাব্য বলিতে আমরা মূল আর্যেতর ভাবধারার সঙ্গে পৌরাণিক সংসারের সমন্বয়ে আদর্শে রচিত মঙ্গল সাহিত্যিককে নির্দেশ করিতেছি। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, শিবায়ন, ধর্মমঙ্গল, কালিকা মঙ্গল ('বিদ্যাসুন্দর')- এইগুলি যথার্থ মহাকাব্যের ধারা। শীতলা মঙ্গল, রায়মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, বাশুলীমঙ্গল প্রভৃতি অপ্রধান মহাকাব্য ইহার অন্তর্ভুক্ত।"
মধ্যযুগের বাংলা মহাকাব্যের প্রধান ধারা তিনটি: মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল এবং ধর্মমঙ্গল।
মঙ্গলকাব্যের প্রধান ত্রয়ী কাব্য মনসামঙ্গলে মনসার মাহাত্ম্য কৃতিত্ব হয়েছে। চন্ডীমঙ্গলে চন্ডী দেবীর মাহাত্ম্য আর ধর্ম ঠাকুরের মাহাত্ম্য কৃতিত্ব হয়েছে ধর্মমঙ্গলে। ধর্মের মোড়কে ঢাকা থাকলেও ধর্মের খোলস ছাড়ালে দেখা যায় যেখানে রয়েছে নানাবিধ সামাজিক উপাদান। এই তিন ধারায় কবিরা ধর্ম মাহাত্ম্য কীর্তন করতে নিয়েও বাস্তব জীবনে প্রেক্ষাপটে। নানাবিধ উপাদানে সংমিশ্রণে ঘটিয়েছেন ।এক কথায় বলা যায় কবিরা সমাজ নামাঙ্কিত রুপ সাগরে গহন গভীরে ডুবিয়ে দিয়ে অপরূপন স্বরূপ নানাবিধ সামাজিক উপাদান আহরণ করেছেন ।তারই যথার্থ বাস্তবায়ন এই মঙ্গলকাব্য ধারা।
আরো পড়ুন: মনসামঙ্গল কাব্যধারায় নারায়ণ দেবের কৃতিত্ব
পঞ্চদশ শতাব্দী যেমন মনসামঙ্গল কাব্যের সমৃদ্ধির যুগ, তেমনি চন্ডীমঙ্গল সমৃদ্ধির যুগ হ'ল ষোড়শ শতাব্দী। তার অন্যতম কারণ চন্ডীমঙ্গলের প্রতিভাধর কবি মুকুন্দ এই শতাব্দীতে তাঁর 'অভয়ামঙ্গল' রচনা করেছিলেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্য গুলিতে দেবী মঙ্গলচন্ডীকার মধ্যে মার্কন্ডেয় পুরানে মহিষাসুরমর্দিনী চন্ডী, লক্ষী বা গজলক্ষী ,সরস্বতী ,বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের নীল সরস্বতী বা ভদ্রকালী, নীল তারা বা জাঙ্গুলী তারা প্রভৃতি পৌরাণিক তথা তান্ত্রিক দেবী গনের মিশ্রণ ঘটেছে। কারণ, তাতে এই অনুমানই স্বাভাবিক। কালিকাপুরাণে বাঙালির শ্রেষ্ঠ পূজা দুর্গা পূজার পদ্ধতির সঙ্গে মঙ্গলচন্ডী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হওয়ার আগেও চন্ডীর পূজা প্রচলন ছিল। সেই জন্য চৈতন্য ভগবতে (বৃন্দাবন দাস) রয়েছেঃ
ধর্ম -কর্ম -লোকে সবে এইমাত্র জানে।
মঙ্গলচন্ডী গীতকারে জাগরণে।।
ক. গোপাল হালদার , তুর্কী আক্রমণের ফলে তিনটি অনিবার্য সামাজিক আবর্তনের কথা বলেছেন-১) উচ্চ নিম্নবর্গের হিন্দুদের মধ্যে সংযোগ নিকটতর হল,২) পরাজিত হিন্দু সমাজ এক সাংস্কৃতিক রচনা করে আত্মরক্ষা করতে সচেষ্ট হলো এবং৩) প্রথমে হিন্দু-মুসলিমদের সাধারণ মানুষের ঐক্য ওক্রমে হিন্দু মুসলমান উচ্চ বর্গের মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপিত হলে পরম সম্মান বিজেতারা বাঙালি হয়ে উঠলেন ,আর বিদেশী ও রইলেন না।'
তুর্কি আক্রমণের ভয়ে ভীত বাঙালি সেই দুর্বিপাকের দিনে এমন একজন দেবাদিদেবের আবির্ভাব কামনা করেছিলেন যারা তাদের এই আশু বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। মঙ্গলকাব্য দেখি -কালকেতুর সঙ্গে চন্ডীর কিংবা চাঁদ সদাগরের সঙ্গে মনসার চুক্তি সম্পর্ক। পূজা দিলে বাড়ি বয়ে ধন বই নিয়ে আসবে,ডুবে যাওয়া বাণিজ্য তোর আর ফিরে পাবে- ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং এই চুক্তির সম্পর্কের জন্য মঙ্গল কাব্যে দেখি ভয়ে ভক্তি জন্ম নিয়েছে। ভয় ও বিস্ময় থেকে তো ধর্ম বোধ জাগে। মঙ্গল কাব্যের দেবী ও সেই ভাবে জাগ্রত হ'ল। তুর্কি আক্রমণে ধ্বংস থেকে মানুষের মধ্যে যত অসহায় চেতনা প্রবল হতে থাকলো তখনই তৎকালীন মানুষের অধি মানসেএক একজন দেবদেবীর উদ্ভব হতে থাকল।
খ. আর্য ও অনার্যের সংমিশ্রনের ফলে পৌরাণিক ও লৌকিক সংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটলো এর ফলে সৃষ্টি হল মঙ্গলকাব্যের দেব দেবীর।
গ. দীর্ঘদিন ধরে বর্ণ হিন্দুরা তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের তথা দেবতাদের অপাংক্তেয় করে রেখেছিল। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের ভয়ে সেই বর্ণ হিন্দুরা পুরনো ঝগড়া ভুলে আবার একত্রিত হওয়ার স্বপ্ন দেখল। তাই বর্ণ হিন্দুরা পুরাণের চর্চা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে পুনরুজ্জীবনে প্রয়াসী হ'ল। তার ফলে মঙ্গলকাব্য গুলির উদ্ভব হলো।
ঘ) বাংলাদেশ নদীমাতৃক। ঝোপ, বন ,জঙ্গল, সমুদ্র নদী বাঙ্গালীর নিত্য জীবনের অঙ্গীভূত। এইজন্য সর্ব দেবী, বনদেবী, শিকারের দেবী, চাষের দেবতা রূপে মঙ্গলকাব্য গুলির দেব দেবীর উদ্ভব অনিবার্য হয়ে উঠল।
যে সমাজে মঙ্গল কাব্যের দেব দেবীর উদ্ভব তা ছিল ব্রাহ্মণ্য সমাজ। নিম্ন সমাজের স্থান সেখানে নগণ্য।
রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারটিকে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছেন -'বাংলার মঙ্গলকাব্য গুলির বিষয়টা হচ্ছে এক দেবতাকে তার সিংহাসন থেকে খেদিয়ে দিয়ে আরেক দেবতার অভ্যুদয়।... এককালে পুরুষ দেবতা যিনি ছিলেন তার বিশেষ কোন উপদ্রব ছিল না। খামোকা মেয়ে দেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন ,আমার পূজা চাই ।অর্থাৎ যে জায়গা দখল নেই,সে জায়গায় আমি তখন করবই। তোমার দলিল কি। গায়ের জোর। কি উপায় দখল করবে ।যে উপায়েই হোক।তারপরে যে সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদ ধন বুদ্ধিতে তাকে সদু পায় বলে না ।কিন্তু পরিণামে এই সকল উপায়েরই জয় হল।"
আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন: "মধ্যযুগের বাংলার সমাজ এই নতুন ও পুরাতনের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করিয়া পরস্পর বিপরীতমুখী দুটি সংস্কারকে এক সূত্রে গাঁথিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। বাংলার জলবায়ুতে দেশীয় লৌকক সংস্কারের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার কিভাবে এক দেহে লীন হইয়া আছে, মঙ্গল কাব্য গুলি তাহারই পরিচয়।"
এরকম আরো বিষয় জানতে যুক্ত হন আমাদের WhatsApp কমিউনিটিতে (এখানে ক্লিক করুন)