ফারাক্কা বাঁধ
আজ আমরা জানব পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে। ফারাক্কা ব্রিজ তৈরী করা শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে এবং নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে।সেই বছর ২১শে এপ্রিল থেকে বাঁধটি চালু হয়। প্রথম প্রশ্ন কেন, কী কারণেই বা গঙ্গা নদীর ওপর এরম একটি বৃহৎ বাঁধ তৈরি করার প্রয়োজন পড়েছিল?
কলকাতা বন্দর গড়ে তোলা হয়েছিল বদ্বীপ অঞ্চলে গঙ্গা নদীর স্বাভাবিক চরিত্র অনুধাবন না করেই, নানা দেশেই এমন বহু বন্দর গড়ে উঠেছিল। কলকাতা বন্দরের হাল ফেরাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে জাহাজ চলাচলের খাপটিতেই ড্রেসিং শুরু করে। তাতে সুবিধা না হওয়ায় কলকাতার ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে মাতলা নদীর ধারেই ক্যানিং বন্দর গড়ে তোলে। কিন্তু একটি দশক না পেরোতেই ১৮৭১ সালে সেটিকে সরকারিভাবে ঘোষণা করে বন্ধ করতে হয়। ভাগীরথী এড়িয়ে মাতলা নদী থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি খাল কাটানোর প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল, পরবর্তীকালে তা বাতিল হয়। মাতলা নদীর তীরে বন্দরটি ১৮৭১ সালের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে বাড়িটি ক্যানিং হাউস নামে পরিচিত। এখানে ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ বন্দর তৈরি হওয়ার ৬ বছর পর পাকাপাকি ভাবে বন্দরটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় ইংরেজ শাসকরা। এরপর গঙ্গার বুকে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে জলপ্রবাহ ভাগীরথীর দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার প্রথম প্রস্তাব দেন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্যার আর্থার কাটান। ১৮৫৩ সালে প্রস্তাবটি তখন আমল পাইনি।
প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৫৭ সালে অর্থাৎ ভারতবর্ষের স্বাধীন হওয়ার পর জার্মান নদীবিজ্ঞানী ওয়াল্টার হেলসেন ভারত সরকারকে পরামর্শ দেন গঙ্গা নদীর উপর ব্যারেজ তৈরি করার। শুকনো মরশুমে ভাগীরথী নদী খাতে যদি চল্লিশ হাজার কিউসেক জল পাঠানো যায় তবে সেই জলের দৌড়ে হুগলির পলি ক্রমে ধুয়ে যাবে এবং জোয়ারের ঠেলায় মোহনা থেকে উজানে পলি এসে নদী খাতে জমা বন্ধ হবে। দেশ বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ এই মতকে সমর্থন করেন। সর্বশেষ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা-বিহার সীমান্তে রাজমহল পাহাড়ের কাছে ফারাক্কায় ব্যারেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন ভারত সরকার। প্রকল্পের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল তিনটি:
১. ভাগীরথী হুগলি নদীর নাব্যতা ফেরানো।
২. উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা।
৩. পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পলতাতে কলকাতা কর্পোরেশনের পানীয় জলে লবণের ভাগ কমানো।
বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনজ্জীবন তার নদীর হাত ধরে আগে এগিয়েছে। বাংলার মর্মের সন্ধানে কপিল ভট্টাচার্য বলেছিলেন "নদী এ ভূমির প্রাণ, এ অঞ্চলের মানুষের ভবিষ্যৎ"। উৎপাদনশীলতার মুক্তিও তাই নদনদীর রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার ওপর পুরোটাই নির্ভরশীল। ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম সেই ব্যক্তি যিনি বাঁধের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কপিল ভট্টাচার্য ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেচ দপ্তরের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার। কপিল ভট্টাচার্য তার স্বাধীন ভারতের নদনদীর পরিকল্পনা বইটিতে জানিয়েছেন, যে তিনি শুকনোর দিনে সাহেবগঞ্জ মনিহার এর কাছে গঙ্গা পারাপার করে তার প্রবাহের মাপ নিতেন। তার ফলেই তিনি দৃঢ় ভাষায় জানান গঙ্গার প্রবাহ এই অংশে কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার কিউসেকের বেশি কখনোই হতে পারেনা। ফারাক্কা ব্রিজের পরিকল্পনার প্রস্তাব ওঠা মাত্রই তিনি সর্বপ্রথম বলেছিলেন 40 হাজার কিউসেকর জল ভাগিরথীতে পাঠানোর জন্য যে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। তার মতে ফারাক্কা ব্যারেজের কাছে মালদহ জেলাকে রক্ষার জন্য গঙ্গার পাড়ে বাঁধের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির ফলে পূর্ণিয়া জেলায় কৌশী নদীর মোহনা পর্যন্ত গঙ্গায় বন্যা প্রবেশ করবে,পূর্ণিয়া ও মালদহ জেলাকে বন্যায় ভাসাবে। ক্রমে ভবিষ্যতে একদিন ওই পথে গঙ্গা তার নতুন খাত সৃষ্টি করে ফারাক্কা ব্যারেজ কে অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে।
ফারাক্কা ব্যারেজের মূল উদ্দেশ্য ক্রমে ব্যর্থ হয়েছে, হুগলি নদী পলি মুক্ত তো হয়নি, বরং পলির পরিমাণ বেড়েছে। কোনভাবেই হুগলি নদীর নাব্যতা ফেরেনি। একটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে ফারাক্কা বাঁধ তৈরীর আগে বছরে প্রায় ৬৪ লক্ষ ঘন মিটার তারা গঙ্গার বুক থেকে প্রেসিন করতেন ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ এই সময়ের মধ্যে ২১২ লক্ষ ঘন মিটার পলি তাদের ড্রেসিং করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত কলকাতা বন্দরে বড় জাহাজের প্রবেশের ব্যবস্থা করা যায়নি বর্তমানে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়নান খাল দিয়ে যে জল ভাগীরথী হুগলি নদীতে প্রবেশ করে তার থেকে প্রায় একশ ষাট গুণ বেশি পলি সমুদ্র থেকে উজানে গঙ্গা পক্ষে প্রবেশ করে। যে কারণে গঙ্গা নদীবক্ষে বাড়ছে পলির সমস্যা। হিমালয়ের পাথর নুড়ি পলি হয়ে সমভূমিতে ফিরে আসার কথা ছিল, প্রাকৃতিক নিয়মে ওই পলিতেই সমৃদ্ধ হতো আমাদের বঙ্গভূমি অর্থাৎ গঙ্গা পদ্মা মেঘনার এই বিরাট ব দ্বীপ অঞ্চল। আর সেই পলি এখন আমাদের সবচেয়ে মাথা ব্যাথার কারণ, যে পরিমাণ পলি প্রত্যেকদিন গঙ্গা বক্ষে জমছে তাকে ঠেলে সাগর পর্যন্ত পাঠানোর ক্ষমতা আজ আর গঙ্গার নেই। ফারাক্কা ব্যারেজ হওয়ার পরে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে ঠিকই, তবে শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য এত বিশাল একটি প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল কি? যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য একটি সেতুই বোধহয় যথেষ্ট ছিল। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে ফারাক্কা ব্যারেজ হওয়ার পরে পদ্মার জলে লবণের ভাগ কমেছে, বর্তমানে পলতা থেকে আরো প্রায় ৪০ কিলোমিটার উজানে অর্থাৎ ত্রিবেদী, পলাগড় ,খয়রামারি, কল্যাণী এই সমস্ত অঞ্চলের গঙ্গার বক্ষে যে দ্বীপ বা চড়ের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে সুন্দরবনের লবণাম্বু উদ্ভিদ অর্থাৎ গরান ক্যাওড়ার মতন গাছ আপনি প্রায় দেখতে পাবেন। লবণাম্বু উদ্ভিদের উপস্থিতি একথা প্রমাণ করে যে গঙ্গার উজানে অনেক দূর পর্যন্ত নোনা জল এখনো প্রবেশ করছে।
সুতরাং ভবিষ্যতে কলকাতার জল প্রকল্প আর থাকবে কিনা তা সময় বলবে। ফারাক্কা ব্যারেজের জন্য কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গবাসী কেও। ফারাক্কা ব্যারেজের বাধা পেয়ে উজানে যে জলাশয় তৈরি হয়েছে সেখানে পলিথিতিয়ে পড়ে নদীগর্ভ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের একটি মৌখিক তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি টনেরও বেশি পলি ফারাক্কা জলাহারে আটকে পড়ে আছে। ফারাক্কার জলাধারটি জলের চেয়ে অনেক বেশি গুণে পলিতে নিমজ্জিত আছে, যার ফল এখনই ভুগতে শুরু করেছে উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্য।
তথ্য সহযোগিতায় - অনুপ হালদার
চিত্র সৌজন্য - ক্যামেলিয়া মিশ্র