শহীদ রাম মহম্মদ সিং আজাদ - জেনে নিন তাঁর জীবনের গল্প

১৮৯৯ সাল ২৬শে ডিসেম্বর - পরাধীন ভারতের বুকে জন্ম নেয় শের সিং, যাকে আমরা চিনি উধাম সিং নামে। ইংরেজদের নিজেদের দেশে গুলি বিদ্ধ করে বদলা নেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের। আসুন আজ জেনে নিই, সেই শহীদের গল্প।

বাবা তেহার সিং, পেশায় চাষী ছিলেন মায়ের নাম  হারনাম কৌর, তাঁদের সন্তানের নাম দিয়েছিলেন  শের সিং। তিনি খুব ছোটবেলাতেই তাঁর মা বাবাকে হারান এর পর তাকে ও তাঁর বড়ো ভাই কে অমৃতসরের সেন্ট্রাল খালসা অনাথ আশ্রমে রেখে আসা হয়। কিন্ত কিছুদিন পর সেই আশ্রমেই তাঁর বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়। সেই সময়ে অনাথ আশ্রমে তাঁর নাম বদলে রাখা হয় উধাম সিং।

১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে রাওলাট অ্যাক্ট অনুযায়ী কংগ্রেসের বেশ কিছু সদস্যকে বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলে, এর প্রতিবাদে ১৩ ই এপ্রিল অমৃতসরে একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করা হয়। উধাম সিং সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই শান্তিপূর্ণ জমায়েতে মাইকেল ও’ডায়ার এর আদেশে নিষ্ঠুর ভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় অগণিত মানুষকে। ৩৭৯ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং একশোর বেশি মানুষ আহত হয়েছিলেন সেইদিন। ইতিহাসের বুকে এই নারকীয় হত্যাকান্ড জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।

উধাম সিং সহ কিছু ব্যক্তি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি মনে মনে শপথ নেন যে এই নারকীয় ঘটনার প্রতিশোধ নেবেন। বেশ কিছু বছর আফ্রিকায় থাকার পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন ১৯২২ সালে। সেই সময় থেকেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি পাঞ্জাবের গদর পার্টিতে ১৯২৪ সালে যোগ দেন। বাইরের নানান দেশে থাকা প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। উধাম সিং সেই সময় নিজে একটি দল তৈরি করেন যার নাম দিয়েছিলেন আজাদ পার্টি। এই সবই ছিল বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।

তারপর তিনি আমেরিকার একটি জাহাজ কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। কাজ করার সময়ই ভূমধ্যসাগর পার  হয়ে তিনি আবার ইউরোপে চলে আসেন।  ইউরোপে অবস্থিত গদর পার্টির বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকেন। সেই সময় তিনি ইতালি ,জার্মান, পোল্যান্ড, ইরান ,হংকং জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ নানান দেশে যান। প্রায় তিন বছর পর ভগৎ সিং এর নির্দেশ অনুসারে ১৯২৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন। ২৫ জন প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে  আন্দোলন শুরু করেন তিনি। পুলিশ গদর পার্টির মুখপত্র "গদার ই গঞ্জের" কাছ থেকে গোলাবারুদ, পিস্তল বাজেয়াপ্ত করে । ১৯৩১ সালে ৫ বছরের কারদণ্ডের পর তিনি মুক্তি পান। তাঁর উপর পাঞ্জাব পুলিশ কড়া নজরদারি শুরু করেন। কিন্তু পুলিশের চোঁখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি সেই সময় বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ছদ্মনামে ,বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে ঘুরতে থাকেন। ১৯৩৪ সালে উধাম সিং লন্ডনে পৌঁছান এবং সেখানে তিনি বেশ কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। সেই সময় থেকেই তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা, মাইকেল ও'ডায়ার কে মারার ছক কষতে থাকেন।

১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ লন্ডনের স্যাক্সটন হলে সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটি এবং ডায়েরের ইস্ট ইন্ডিয়া এসোসিয়েশনের একটি যুগ্ম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ডায়েরের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। উধাম সিং একটি বইয়ের ভেতর পিস্তল ঢুকিয়ে সেই সভাই নিয়ে যান। সভা চলাকালীন শেষের দিকে মাইকেল ও'ডায়ার বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যখন মঞ্চের দিকে যেতে থাকেন তখন উধাম সিং তার দিকে দুবার গুলি নিক্ষেপ করেছিলেন, সেই দুটিগুলির মধ্যে একটি গুলি ডায়েরের বুকের মধ্যে গিয়ে লাগে এবং তিনি তৎক্ষণাৎ মারা যান। এছাড়াও লুইস ড্যান, লরেন্স ডান্ডাস,দ্বিতীয় মার্কেরজ অফ জেটল্যান্ড এবং চার্লস কোচ্রান মারা যান উধাম সিং এর গুলিতে। 

এই ঘটনার পর উধাম সিং আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে ব্রিকস্টন জেলে বন্দী করা হয়। বন্দী থাকাকালীন তিনি নিজেকে "রাম মহম্মদ সিং আজাদ" নামে পরিচয় দিতেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানাতে ৪২ দিন ধরে অনশন করেছিলেন এবং ৪ই জুন সেন্ট্রাল ক্রিমিনাল কোর্টে তাঁর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। ১৯৪০ সালের ৩১ শে জুলাই পেনটনভিল জেলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সকল দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাঁর এই অসীম সাহসিকতাকে সমর্থন জানানো হয়। ১৯৯৫ সালে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উত্তরাখণ্ডের একটি জেলার নাম পাল্টে উধাম সিং নগর রাখা হয়।

লেখাটি শেয়ার করুন নিজেদের বন্ধু ও পরিবারের লোকজনদের মধ্যে এবং তাঁদের জানান ভারতীয় ইতিহাসের এক যোদ্ধার কথা!

পোস্টারে ব্যবহার করা ছবির চিত্র সৌজন্য: উকিমিডিয়া কমন্স  (Source and  Author: Punjab martyrs museum)

নবীনতর পূর্বতন